Contact

হোমিওপ্যাথি কী?, কাজী আজম
09 Jun, 2024

হোমিওপ্যাথি কী?, কাজী আজম

বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব বি. কে. সরকার হ্যানিম্যান’স অর্গানন অব মেডিসিন বইয়ের ৯৫ পৃষ্ঠায় হোমিওপ্যাথির দু’টি সংজ্ঞা দিয়েছেন-

এক. বৃহত্তর অর্থে হোমিওপ্যাথি, প্রথমতঃ বিজ্ঞান ভিত্তিক অধ্যয়ন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রিয় অনুশিলনের একটি পদ্ধতি বুঝায়; দ্বিতীয়তঃ এই পদ্ধতির সাহায্যে প্রকৃত তথ্য বা ঘটনা উদ্ঘাটন বুঝায়; এবং তৃতীয়তঃ প্রস্তাব অনুযায়ী উদ্ঘাটিত তথ্য বা ঘটনার ব্যাখ্যা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের তত্ত্ব নির্দেশ করে।

অন্য কথায় হোমিওপ্যাথি একটি নিদৃষ্ট নীতির ভিত্তিতে রোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ওষুধ সমূহ প্রয়োগের একটি বিশেষ উপায় বুঝায়, যাকে বলা হয় “similia similibus curenture” (যে ওষুধে যে রোগ সৃষ্টি করতে পারে সেই ওষুধে সেই রোগ সারবে); এবং vital force, chronic miasm ও ওষুধের গতিশীলতা তত্ত্ব বুঝায়।

দুই. সংকীর্ণ ও কঠোর অর্থে হোমিওপ্যাথি হচ্ছে ওষুধ প্রয়োগের জন্য অনুশীলনের একটি নিয়ম এবং তা একই প্রকৃতির অন্যান্য (শারীরিক) উপসর্গের ভিত্তিতে প্রযোজ্য হয়, অথবা বলা যেতে পারে “সদৃশ ওষুধ বিধান” (যেমন শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ‘homois’ অর্থ সদৃশ অথবা similar – ‘pathos’ অর্থ কষ্টভোগ)।

অন্য কথায় হোমিওপ্যাথি হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যাবস্থায় যেই ওষুধ প্রয়োগের পর প্রুভারদের মধ্যে যে সকল কষ্টভোগ দেখা দেয় সেই ওষুধ প্রয়োগ করে কোন ব্যক্তির তদ্রুপ কষ্টভোগ দূর করার একটি পদ্ধতি, এটি বিশেষায়িত ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা প্রণালী এবং এর চেয়ে বেশিও নয় কিংবা কমও নয়।

এ দু’টি সংজ্ঞা হোমিওপ্যাথির দু’টি ধরণ চিহ্নিত করে,

বৃহত্তর অর্থে- বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যক্তির বর্তমান কষ্টের কারণ উদ্ঘাটন করে সেই কারণ নিবারণের জন্য similimum ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি, এবং

সংকীর্ণ অর্থে- ব্যক্তির বর্তমান কষ্ট নিবারণের জন্য similar ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি।

আমরা পূর্বের আলোচনায় জেনেছি- বর্তমান কষ্টের কারণ হচ্ছে true disease এবং বর্তমান কষ্টের অপর নাম results of disease ।

স্যার শ্যামল কুমার দাস এর সংজ্ঞা অনুযায়ী-

যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে true disease এর চিকিৎসা করা হয় এবং এই চিকিৎসার জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণালব্ধ গঠনপ্রকৃতি সংশোধনকারী হোমিওপ্যাথিক similimum ওষুধ (Constitutional medicine) একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে প্রয়োগ করা হয় তাকে রিয়েল হোমিওপ্যাথি বলে।

অন্যদিকে, যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে results of disease এর চিকিৎসা করা হয় এবং এই চিকিৎসার জন্য মেটেরিয়া মেডিকা কিংবা রেপার্টরী থেকে সিম্পটম বা রুব্রিক মিলিয়ে হোমিওপ্যাথিক similar ওষুধ একটি সাধারণ নিয়ম মেনে প্রয়োগ করা হয় তাকে সুপারফিসিয়াল হোমিওপ্যাথি বলে।

রিয়েল হোমিওপ্যাথি কথাটি স্যার জেমস টাইলার কেন্ট তাঁর লেকচার অন হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকায় কার্বোভেজ চ্যাপ্টারের ৩০ প্যারায় উল্লেখ করে বলেছেন-

তুমি দশ বছর রিয়েল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার পর অবাক হয়ে যাবে যে, তোমার চিকিৎসায় খুব কম বিকলাঙ্গ শিশুই জন্ম নিয়েছে; তারা সকলে বেড়ে উঠেছে এবং শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে; তাদের ছোট খাটো দোষ ও বিকৃতি বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেরে গেছে, এবং তারা অধিকাংশ শিশু অপেক্ষা সুন্দর হয়েছে, কারন তাদের সুশৃংখল অবস্থায় রাখা হয়েছে। ডাক্তার শিশুটিকে দেখে-শুনে-বুঝে মাঝে মধ্যে অল্প অল্প ওষুধ খাওয়ান, মায়ের মনে হয় ডাক্তার তার সন্তানকে খুশি রাখার জন্য সুগার খাওয়াচ্ছেন। এটি ওষুধ কিনা কিংবা সন্তানের কোন অসুখ-বিসুখ হয়েছে কিনা তা মায়ের জানার প্রয়োজন নেই। তিনি শুধু সমস্ত রোগ বালাই থেকে মুক্ত অবস্থায় তার ছোট্ট সোনামনির উন্নতি ও বড় হয়ে উঠা লক্ষ্য করতে থাকেন। যে শিশুরা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বাড়তে থাকে তাদের কখনও যক্ষা বা কিডনী রোগ হবে না; তাদের শৃংখলা বজায় থাকবে এবং বৃদ্ধ বয়সে মরবে অথবা নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম ও চিন্তায় উপযুক্ত বয়সে জীর্ণ হবে; তাদের কখনও মরিচা ধরে ক্ষয় হবে না। ছোট্ট সোনামনিদের প্রতি লক্ষ্য রাখা চিকিৎসকের কর্তব্য। তাদেরকে পারিবারিক রোগ বালাই এবং অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে পারা চিকিৎসক জীবনের এক বড় কাজ।

অন্যদিকে সুপারফিসিয়াল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কে স্যার জেমস টাইলার কেন্ট তাঁর ফিলোসোফির ২৩ পৃষ্ঠায় সতর্কবাণী দিয়েছেন-

Prescribing for the results of disease causes changes in the results of disease, but not in the sickness except to hurry its progress.

রোগের পরিনামফলের উপর নির্ভর করে ওষুধ নির্বাচন করলে সেগুলির উপশম হয় ঠিকই, তবে sickness এর জন্য ওষুধ নির্বাচন না করতে পারার জন্য মূল রোগটি ভিতরে ভিতরে বাড়তে থাকে।

স্যার শ্যামল কুমার দাস একজন চিকিৎসকের রিয়েল হোমিওপ্যাথি ব্যতীত সুপারফিসিয়াল হোমিওপ্যাথি সহ অন্যান্য সকল প্রকারের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করাকে রোগী ও তাঁর স্বজনদের সাথে প্রতারণা, বিশ্বাস ঘাতকতা এবং মারাত্মক অপরাধ মূলক কাজ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কেননা তাৎক্ষনিকভাবে কষ্ট নিবারণের জন্য উপশম বা দমনমূলক এই সকল চিকিৎসার কারণে ভয়ঙ্করভাবে ভিতরে ভিতরে আসল রোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মানব সমাজের মানসিক স্তরে বিচ্যুতি (deviation) বা স্বেচ্ছাচারিতা (perversion) সৃষ্টি হয়ে থাকে; এরফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে বিভক্তি, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু রিয়েল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় এরকম কিছুই ঘটে না বরং মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনায় অন্যায় বা অসঙ্গতি থাকলে তাও দূর হয়ে মানুষটিকে ইতিবাচক হতে সাহায্য করে।